![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgSX8-SbOnWFcReBATGlx6lFEiANPr1E-ROgVNHizBxV856uZaHvkj9gXxi9O8NuerTvx4FSivjRuCFIqK-qZYoGyxEEmSQX2A0rTCUFDbnBqSabPMy7jOdIlb0s615jyuGAWXJi6E4M4e_/s400/%25E0%25A6%25AA%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%2587+%25E0%25A6%25A1%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BF%25E0%25A7%259F%25E0%25A7%2587+%25E0%25A6%25AF%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%25AD%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AC%25E0%25A7%2587+%25E0%25A6%25B9%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AF%25E0%25A6%25BE+%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%25BE+%25E0%25A6%25B9%25E0%25A7%259F+%25E0%25A6%25A6%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%2587+%25E0%25A6%2595%25E0%25A6%25B2%25E0%25A7%2587%25E0%25A6%259C+%25E0%25A6%259B%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25A4%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B0%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%2587.jpg)
হত্যার
এ এক নিষ্ঠুর পদ্ধতি। শিকার দুই কলেজছাত্র। সময়ের ব্যবধান দুই সপ্তাহ।
কিন্তু পদ্ধতি একই। অপহরণের পর নিয়ে যাওয়া হয় নদীতে । হাত, কোমর, বুক দড়ি
আর গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর শরীরের সঙ্গে বেঁধে দেয়া হয় রানা
প্লাজার ধ্বংসস্তূপের পাথর। পরিবারের সদস্যদের শোনানোর জন্য রেকর্ড করা হয়
মুক্তিপণের কথা। কিন্তু জীবিত রাখা হয় না তাদেরকে। ডুবিয়ে দেয়া হয় মাঝ
নদীতে।
কলেজছাত্র মনির হোসেন ও মুনসের আলী মুন্না হত্যার এ ভয়ঙ্কর বিবরণ
দিয়েছে এ ঘটনায় গ্রেপ্তার আনোয়ার হোসেন এবং লাল মিয়া। ম্যাজিস্ট্রেটের
কাছে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে তারা বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে দুটি
হত্যাকাণ্ডের। যে জবানবন্দিতে ওঠে এসেছে হত্যাকাণ্ডের প্রধান হোতা হিসেবে
বাদশার নাম।
কলেজছাত্র মনির হোসেন ও মুন্না। মনির পড়তো মানিকগঞ্জ খান
বাহাদুর আওলাদ হোসেন কলেজে একাদশ শ্রেণীতে। সে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার
শিমুলিয়া গ্রামের কুয়েত প্রবাসী পরশ আলীর ছেলে। মানিকগঞ্জ শহরের সেওতা
এলাকার একটি মেসে থাকতো। অন্যদিকে, মুন্না পড়তো সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে।
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চন্দ্রপুর গ্রামের আবদুল মান্নানের ছেলে। সে
তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে সাভার পৌর এলাকার আড়াপাড়া মহল্লায় থাকতো। চিত্রশিল্পীর
কাজ করে পড়ালেখা করওতা মুনসের আলী মুন্না। মুন্নাকে অপহরণ করা হয় গত ২৫শে
আগস্ট। এর দুই সপ্তাহ পর অপহরণ করা হয় মনিরকে। দুটি ক্ষেত্রেই পরিবারের
কাছে দাবি করা হয় বড় অঙ্কের মুক্তিপণ। পুলিশ এ অপহরণকারী চক্রের ছয় সদস্যকে
গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। মনিরের লাশ উদ্ধার হলেও মুন্নার লাশ এখনও
উদ্ধার হয়নি।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি:
সূত্র জানায়, জবানবন্দির শুরুতে আনোয়ার হোসেন তার সঙ্গে এ ঘটনার মূল হোতা
বাদশার কিভাবে যোগাযোগ গড়ে ওঠে তার বর্ণনা দেয়। এরপর জবানবন্দিতে সে বলে,
২৫/৮/১৫ তারিখ রাত ৮টার দিকে বাদশা আমাকে ফোন করে সাভার নামাবাজার যেতে
বলে। এরপর আমি ভ্যান চালিয়ে এসে একা একা রাত ৮টার পরে সাভার নামাবাজার
খেয়াঘাট এলাকায় যাই। সেখানে গিয়ে বাদশা, আজগর, লাল মিয়াসহ অনেককে দেখি।
তারপর বাদশার কথামতো আমি, আজগর, লাল মিয়া এবং বাদশা মিলে নদীতে নৌকায় উঠি
এবং নৌকায় আরও কয়েকজন লোক ছিল। তারপর নদীর ওপারে গিয়ে আমি, বাদশা, লাল
মিয়া, আজগর এবং অপর দুই জন ব্যতীত বাকি লোক নৌকা থেকে নেমে যায়। তারপর নৌকা
নিয়ে আবার নদী দিয়ে সিংগাইর ব্রিজের দিকে কিছুদূর গেলে বাদশা সবাইকে বলে
নৌকায় থাকা মুন্নাকে জিম্মি করে টাকা নিতে হবে। মুন্না নৌকার মধ্যে ছিল এবং
মুন্নাকে বাদশাসহ অন্যরা নিয়ে গিয়েছিল। মাঝির নাম লাল মিঞা এবং সে নৌকার
মালিক। নদী দিয়ে চলতে চলতে নদীর মাঝে গিয়ে বাদশা মুন্নাকে চড় মারে এবং
আমাকে মুন্নাকে ধরতে বলে। বাদশার কথামতো আমি, আজগর মুন্নাকে ধরে রাখি।
বাদশা, মাঝি লাল মিয়া এবং অপরিচিত দুজন মুন্নার মুখ গামছা দিয়ে বাঁধে এবং
হাত-পা বেঁধে ফেলে এবং মুন্নার মোবাইল ছিনিয়ে নেয় বাদশা। মুন্নার বাড়ির
মোবাইল নম্বর নিয়ে বাদশা মুন্নার বাড়িতে কথা বলে এবং ৩০০০০০ টাকা মুক্তিপণ
দিতে বলে। তখন রাত ৯টা বাজে। মুন্নার কথাগুলো বাদশা রেকর্ড করে রাখে। নৌকার
মধ্যে পাথর-দড়ি এগুলো বাদশা ও লাল মিঞা তুলে রাখে। বাদশা ও লাল মিয়া এবং
অন্য দুইজন দড়ি দিয়ে মুন্নার পা, মাজা, বুক ও হাত বাঁধে এবং পূর্বেই গামছা
দিয়ে মুখ বাঁধা ছিল। আমি ও আজগর তাদের নিষেধ করি। কিন্তু তারা মানেনি। এবং
সকলেই মিলে হাত-পা-মুখ-মাজা বাঁধা অবস্থায় সাড়ে ৯টার দিকে (অনুমান) সিংগাইর
ব্রিজের আগে তাকে নৌকা থেকে নদীর মধ্যে ফেলে দেই। এরপর যে যার মতো বাড়িতে
চলে যাই। এর দুই সপ্তাহ পর একই কায়দায় এই চক্র খুন করে মনিরকে।
জবানবন্দিতে
আনোয়ার বলে, মুন্নার মতো করে একই কায়দায় নদীর মাঝখানে গিয়ে সকলে মিলে
মনিরের হাত-মুখ-পা ও মাজা দড়ি দিয়ে বাঁধা হয় এবং রানা প্লাজার পাথর দিয়ে
দড়ির সঙ্গে বেঁধে মনিরকে নদীর মাঝে ফেলে দেয়া হয়। নদীর মাঝখানে বাদশাসহ
অন্যরা মনিরকে মারধর করে মোবাইল কেড়ে নেয় এবং মনিরের মা-চাচার সঙ্গে কথা
বলায়। ওই সময় মনির বাদশাকে বলে মেরে ফেলো না ৪০০০০০০ টাকা লাগলেও দিব।
তারপর বাদশা মনিরের মোবাইল দিয়ে তার মায়ের নিকট ২০০০০০০ টাকা চাঁদা দাবি
করে এবং মোবাইলে কথা রেকর্ড করে। তারপর চালক লাল মিয়া, বাদশা, আজগর অন্য
দুইজন রানা প্লাজার ভাঙাপাথর দিয়ে বেঁধে সিংগাইর ব্রিজের কিছু আগে ফেলে
দেই। তারপর আমরা যে যার মতো চলে যাই। মুন্না ও মনিরকে আমরা একইভাবে, একই
নৌকায়, একই লোকজন মিলে দড়ি ও গামছা দিয়ে বেঁধে নদীতে ফেলে হত্যা করি। আমি
আমার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত। এটাই আমার জবানবন্দি।
লাল মিয়া জবানবন্দিতে
বলে, গত ২৫শে আগস্ট সন্ধ্যা ৭টার সময় বাদশা আমাকে ফোন করে জানায়, তারা ৪-৫
জন মিলে আমার নৌকায় সাভার ঘাট থেকে সিংগাইর ব্রিজ পর্যন্ত ভ্রমণ করবে।
ঘটনার তিনদিন আগে আজগর ও আনোয়ার খেয়াঘাটে বেলা ১টার দিকে আমার সঙ্গে দেখা
করে বলে ২৫শে আগস্ট বিকাল বেলা আমার নৌকায় ভ্রমণ করবে এবং ১৪০০ টাকা ভাড়া
দেবে। কথামত ২৫শে আগস্ট বাদশা, আজগর, আনোয়ার ও ভিকটিম মুন্নাকে ঘটনার দিন
সন্ধ্যা ৭টায় সাল্লাঘাটে নিয়ে আসে। আমার ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তারা বসে। আর
আমি একাই ট্রলার চালাচ্ছিলাম। তাদের কথামতো সাভার সাল্লাঘাট থেকে সিংগাইর
ব্রিজের দিকে যাত্রা শুরু করি। ট্রলার চলার আধ ঘণ্টা পর আজগর ও আনোয়ার
আমাকে কাছাকাছি থাকতে বলে। এরপর বাদশা ভিকটিম মুন্নার হাত বাঁধে, আজগর
মুন্নার কোমর বাঁধে এবং বাদশা গামছা দিয়ে মুন্নার চোখ বাঁধে। বাদশা মুন্নার
মোবাইল ফোন নিয়ে তার পরিবারের কাছে চাঁদা দাবি করে। এক পর্যায়ে মুন্নার
কোমরে পাথর বেঁধে তাকে নদীতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। একইভাবে ভিকটিম মনিরকে
নিয়ে সন্ধ্যা ৭ টা ১৫ দিকে বাদশা, আজগর, আনোয়ার বালুঘাট আসে। তারা চারজন
আমার নৌকায় বসে। পনের মিনিট পর ওরা মনিরকে কিল ঘুষি মারে। এরপর বাদশা
মনিরের চোখ বাধে গামছা দিয়ে। আজগর রশি দিয়ে মনিরের হাত বাধে। আনোয়ার রশি
দিয়ে পা বাধে। এরপর মনিরের মার কাছে মুক্তি পনের জন্য ফোন দেয়। মনিরের মা
মুক্তিপন দিতে রাজি হয়। এরপর রাত পোনে ১০ টার দিকে সিংগাইর ব্রিজের একটু
উজানে ওরা তিনজন মনিরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এভাবেই হত্যা করা হয় কলেজ
ছাত্র মনিরকে।
পরিবারের বক্তব্য:
মুন্না এবং মনিরের পরিবারের সদস্যরা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বর্বর এ
হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছেন। সরজমিন মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার
মহাদেবপুর ইউনিয়নের শিমুলিয়া এলাকায় নিহত মনির হোসেনের বাড়ি গিয়ে দেখা
গেছে, এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। কান্না থামছে না মনিরের পরিবারে। বারান্দার এক
কোণে বসে কাঁদছেন মনিরের মা মালেকা বেগম। আর মনিরের একমাত্র ছোট বোন ৭ম
শ্রেণীর ছাত্রী খাদিজা ভাইয়ের জন্য কাঁদছে। ওকেও থামাতে পারছে না কেউ।
মনিরের বাবা পরোশ আলী কুয়েত প্রবাসী। ছেলের মৃত্যুর খবরে রোববার সে কুয়েত
থেকে বাড়ি এসে ছেলের শোকে দিশাহারা হয়ে পড়েন। নিহত মনির হোসেনের মা মালেকা
বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ঘটনার দিন দুপুরে মনির মোবাইলে আমাকে বলে মা
আমার মেসের বুয়া থাকবে না। আমাকে রান্না করে কে খাওয়াবে। তাই আমি বিকালে
বাড়ি চলে আসবো। কয়েক দিন বাড়ি থেকেই কলেজ করবো। এরপর আমি মাগরিবের নামাজ
শেষ করে ছেলের মোবাইলে ফোন করতে থাকি। কিন্তু মনির আমার ফোনটি রিসিভ করছিল
না। পরে রাতে মনিরের নাম্বার থেকে একটি লোক ফোন করে আমাকে গালি দিয়ে বলে,
তোর ছেলেকে যদি জীবিত দেখতে চাস তাহলে এখনই ২০ লাখ টাকা বিকাশে পাঠিয়ে দে।
ফোনে আমি ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চাইলাম কিন্তু ওদের দয়া হলো না। তিনি
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরও বলেন, আমার মনিরের স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীর চাকরি
করবে। আমার সব স্বপ্ন ঘাতকরা শেষ করে দিয়েছে। গ্রাম থেকে শহরে কলেজ করতে
কষ্ট হবে ভেবে আমি মনিরকে মেসে রেখে লেখাপড়া করাচ্ছিলাম। নিহত মনিরের
একমাত্র ছোট বোন ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী খাদিজা ভাইয়ের জন্য হাউমাউ করে কাঁদছে।
ছোট্ট খাদিজাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা কারো নেই। খাদিজা বলেন, আমার ভাই
যেদিন ছুটি শেষে বাড়ি থেকে শহরে যায় সেদিন আমাকে বলে যায়, ঠিক মতো
খাওয়া-দাওয়া ও লেখাপড়া করো। আমি চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে হাট থেকে আমার জন্য
একটি আখ নিয়ে আসে। এ কথা বলতেই কান্না আরও বেড়ে যায় ছোট বোন খাদিজার।
পুলিশের বক্তব্য:
পুলিশ জানায়, মনির হোসেন ও মুন্না অপহরণের ঘটনায় একই বিকাশ নম্বর থেকে
টাকা নেয়া হয়। পরে তাদের পরিবার পুলিশকে বিষয়টি জানালে পুলিশ মোবাইল
ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে সাভার, ধামরাই ও মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান
চালিয়ে তাদের আটক করতে সক্ষম হয়। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে সাভার, ধামরাই ও
মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অপহরণ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। মনসুরের ভাইয়ের
অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার থেকে সাভার পুলিশ অপহরণচক্র গ্রেপ্তারে অভিযান
শুরু করে। প্রথমে বাদশাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার দেয়া তথ্যে বাকি ৫
জনকে আটক করে পুলিশ। আটকের পর সাভার থানা শুক্রবার আয়োজন করে একটি সংবাদ
সম্মেলন। সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল আজিম
বলেন, প্রযুক্তির সহায়তায় সাভারের আড়াপাড়া থেকে প্রথমে বাদশাকে গ্রেপ্তার
করা হয়। এরপর তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাকি পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা অপহরণের বিস্তারিত খুলে বলে।
Comments[ 0 ]
Post a Comment