দলবেঁধে
আসা শরণার্থীদের একধরনের বাড়তি বোঝা বলে মনে করে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ।
কাঁটাতারের বেড়া, পুলিশের পিটুনি, কাঁদানে গ্যাস দিয়ে এই জনস্রোত আটকে
রাখছে। ঢুকতে দিচ্ছে না। এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম জার্মানি। তুরস্কের সাগরতীরে
সিরীয় শরণার্থী তিন বছরের শিশু আয়লানের নিথর দেহ ভেসে আসার পর জার্মানিই
প্রথম সাহস দেখায়। দুয়ার খুলে দেয় শরণার্থীদের জন্য। ফুল, চকলেট, গরম কাপড়
দিয়ে মিউনিখ স্টেশনে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানায় শরণার্থীদের। তবে আট লাখ
শরণার্থী নেওয়ার পর অনেকটা কঠোর হয় তাঁরা। সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করে।
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর শরণার্থী নিয়ে এত বড় সংকটে আর পড়েনি ইউরোপ-এ কথা স্বীকার
করেছে জার্মানি। এ বছর তাই দেশটি আট লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা
দেয়। তবে ১৫ সেপ্টেম্বর জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর সিগমার গ্যাব্রিয়েল
বলেন, তাঁদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমান, এই সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে
যাবে।
অন্য দেশগুলো যেখানে শরণার্থীদের বোঝা মনে করে, জার্মানি সেখানে
তাদের কাজে লাগাতে চায়। নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তি বাড়াতে চায়। শ্রমবাজারকে
গতিশীল করতে চায়। কারণটা খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এদের নিয়ে জার্মানির ভাবনা
সুদূরপ্রসারী।
বার্লিনে গত কয়েক বছরে জনসংখ্যা ক্রমশ কমছে। দেশটিতে
জনসংখ্যার জন্মহারের চেয়ে মৃত্যুহার বেশি। হিসেব করে দেখা গেছে, ২০৩০ সালের
মধ্যে বার্লিনে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ৬০ লাখ কমে যাবে। দেশটির ভাইস
চ্যান্সেলর অর্থমন্ত্রী সিগমার গাব্রিয়েল গতকাল বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে
বলেন, যদি জার্মানি দ্রুত প্রশিক্ষণ দিয়ে শরণার্থীদের কর্মসংস্থান করতে
পারে, তাহলে অর্থনৈতিক সংকট এড়ানো সম্ভব। তারাই তখন অর্থনৈতিক শক্তিতে
পরিণত হবে। শরণার্থীদের প্রশিক্ষিত ও দক্ষ করে গড়ে তোলা জার্মান সরকারের
জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা প্রস্তুত।
এ বছর আসা আট
লাখ শরণার্থীকে ঘিরে এর মধ্যেই জার্মানিতে ক্ষুদ্র ব্যবসা গড়ে উঠেছে।
ব্যবসার ক্ষেত্র আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। জার্মানির ডর্টমুন্ড শহরের
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল কক। তিনি গৃহনির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা করেন।
শরণার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যবসার কাজে লাগাচ্ছেন তিনি। স্থানীয়
বাণিজ্যিক সংস্থার পরামর্শে এ উদ্যোগ নেন কক। আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়ার
শরণার্থী তেসভাজেব্রিয়েল আবরাহা নির্মাণকাজের কলাকৌশল জানতেন না। দুই
সপ্তাহ প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। তবে শরণার্থীদের
প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো দক্ষ লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হয় বলে জানান কক।
জার্মানির
আর্থিক প্রতিষ্ঠান ডিআইডব্লিউয়ের প্রধান মার্সেল ফ্রাৎজশার বলেন, গত পাঁচ
বছরে ইউরোপে প্রায় দেড় লাখ নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নতুন চাকরির
প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই পূরণ করেছে শরণার্থীরা। ফ্রাৎজশার বলেন, জার্মানির
অর্থনীতিকে গতিশীল করতে তাঁদের আরও নতুন কর্মী দরকার। ডর্টমুন্ডের স্থানীয়
বাণিজ্যিক সংস্থা এইচডব্লিউকের মুখপাত্র বলেছেন, এই শহরে অনেক শিল্প
কারখানায় চাকরির সুযোগ আছে। কিন্তু যোগ্য কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না। জার্মানরা
সাধারণত উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী। শিক্ষাজীবন শেষ করার আগে তাঁরা কোনো কাজ
জড়াতে চান না। এতে শিল্প কারখানাগুলোর অনেক পদই শূন্য থাকে। এসব ক্ষেত্রে
জার্মানি শরণার্থীদের কাজে লাগাতে চায়।
জার্মানির জনবহুল নর্থ রাইন
ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যে শরণার্থীদের এক-পঞ্চমাংস আশ্রয় নিয়েছেন। এই রাজ্যের
শহর ডর্টমুন্ডে প্রায় চার হাজার শরণার্থী এসেছে। তাঁদের কর্মসংস্থানের কথা
ভাবা হচ্ছে। এ বছরের শুরুতে সিরিয়া, আফ্রিকার কঙ্গো ও ইরিত্রিয়া থেকে আসা
৮৫ জন শরণার্থীর অঙ্ক ও ভাষা বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এর পরে তাঁদের
বৈদ্যুতিক, যান্ত্রিক, ধাতব পদার্থ ও নির্মাণসামগ্রীর কাজের ওপর প্রশিক্ষণ
দেওয়া হবে।
এইচডব্লিউকের মুখপাত্র বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠান শরণার্থীদের
বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এসব শিক্ষানবিশ শরণার্থীদের খুব কম
বেতনে কাজ করানো হয়। প্রতি ঘণ্টায় নির্ধারিত সর্বনিম্ন বেতন ৮ দশমিক ৫০
ইউরোরও কম পান তাঁরা। তাদের বেতনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই।
ডর্টমুন্ডে এইচডব্লিউকের প্রধান বার্টহোল্ড শ্রোয়েডার শরণার্থীদের
জনশক্তিতে কাজে লাগানোর এই পাইলট প্রকল্পের উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, যেসব
প্রতিষ্ঠান শরণার্থীদের কাজ দেয় তাঁরা নানাভাবে সহায়তা করে। অনেক সময় থাকার
বন্দোবস্তও করে দেয়। তবে একেবারে অদক্ষ ও অশিক্ষিত শরণার্থীরা জার্মানির
জন্য গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়ায়।
দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টমাস ডি
মেজিয়র বলেন, সিরীয় শরণার্থীদের অনেকে উচ্চশিক্ষিত। আবার অনেকে স্বল্প
শিক্ষিত। এরা দেশের জন্য একধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। শ্রমমন্ত্রী আন্দ্রে
নাহলেস বলেন, আট লাখ শরণার্থীর মধ্যে চার লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীকে জার্মানি
কাজে লাগাতে পারবে। দক্ষতার অভাবের কারণে তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্য,
আবহাওয়া, সংস্কার কাজে শ্রমিকদের কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আবার যেসব
শরণার্থী প্রশিক্ষণ নিয়ে ভালো কাজ করছে, তাদের স্থায়িত্ব সম্পর্কে একধরনের
শঙ্কা রয়েছে।
ইনস্টিটিউট ফর দ্য ফিউচার অব ওয়ার্কের গবেষণা বিভাগের
উপপরিচালক উলফ রাইন বলেন, প্রশিক্ষণের পর শরণার্থীরা অন্য কোথাও চলে যেতে
পারে। যারা দীর্ঘ বা মধ্য মেয়াদে কাজ করবে, তারা শ্রমবাজারকে গতিশীল করতে
পারবে। রয়টার্স অবলম্বনে
Comments[ 0 ]
Post a Comment