আশির
দশকের শুরুতে ১৯৮২ সালে দেশের মর্যাদাশীল পত্রিকা দৈনিক বাংলায়
বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিই। তখন পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন
দেশবরেণ্য কবি শামসুর রাহমান। নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন খ্যাতিমান সাংবাদিক
আহমেদ হুমায়ুন। ওই বছর নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের
বিএনপি সরকারকে বন্দুকের নলের মুখে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন তৎকালীন
সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ। দেশ ছিল সামরিক শাসনের কবলে। পত্রপত্রিকার ওপর
আরোপ করা হয়েছিল কঠোর সেন্সরশিপ। বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তথা
রাজনীতিবিষয়ক রিপোর্ট ও লেখালেখির ওপর ছিল বিশেষ বিধিনিষেধ। ফলে
পত্রপত্রিকায় গুরুত্ব পেত রাজনীতির বাইরে সামাজিক বিষয়ভিত্তিক খবর। তখন এত
পত্রিকা ছিল না। স্বনামধন্য পত্রিকার মধ্যে ছিল দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক
বাংলা, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক দেশ, দৈনিক আজাদ, বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলাদেশ
টাইমস ও বাংলার বাণী। সার্কুলেশন কম হলেও বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সাহসী রিপোর্টের
জন্য দৈনিক সংবাদ ছিল আলোচিত পত্রিকা। প্রায় বিজ্ঞাপনশূন্য এ পত্রিকাটি
থাকত রিপোর্টে ঠাসা। তখন সাংবাদিকতা জগতে দৈনিক সংবাদের একজন স্টাফ
রিপোর্টার হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। পত্রিকা খুললেই পাওয়া যেত তার সাড়াজাগানো
রিপোর্ট। একেক দিন একেক ধরনের রিপোর্ট। এক দিন হয়তো সামাজিক রিপোর্ট; পরের
দিন অর্থনীতির রিপোর্ট। এমনিভাবে প্রশাসনের ভেতরের অনুসন্ধানী রিপোর্ট-
ঘুষ, দুর্নীতি, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় নিয়ে রিপোর্ট। রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও
রাজনীতির ওপরও কৌশলী রিপোর্ট করতেন তিনি। পত্রিকার প্রথম পাতায় বিশেষ
ট্রিটমেন্টে রিপোর্টগুলো ছাপা হতো। ফলে সহজেই তা সবার দৃষ্টি কাড়ত।
শ্রদ্ধাভাজন
সাংবাদিক আহমেদ হুমায়ুন যিনি সাংবাদিকদের কাছে হুমায়ুন ভাই হিসেবে পরিচিত,
তিনি আমাদের প্রায়ই ওই রিপোর্টারের উদাহরণ দিতেন। দৈনিক বাংলার বাইরে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষকও ছিলেন
হুমায়ুন ভাই। ওই রিপোর্টার ছিলেন তার প্রিয় ছাত্র। তিনি প্রায়ই বলতেন ছাত্র
হিসেবে সে অত্যন্ত মেধাবী, সাংবাদিকতায় এসেও মেধার স্বাক্ষর রাখছে। আমাদের
তিনি উপদেশ দিতেন- ‘তাকে ফলো করো, তার রিপোর্টগুলো পড়ো এবং সেভাবে
রিপোর্টের পেছনে দৌড়াও।
আলোচিত এই রিপোর্টার শওকত মাহমুদ। তার রিপোর্ট
যে-কাউকেই নাড়া দিত। অনুসন্ধানী রিপোর্ট যাকে বলে, হৃদয়গ্রাহী রিপোর্ট যাকে
বলে, ডেপথ রিপোর্ট যাকে বলে শওকত মাহমুদের রিপোর্ট তার অনন্য উদাহরণ। শওকত
মাহমুদের সাথে তখনো পরিচয় হয়নি। তবে দৈনিক সংবাদে তার রিপোর্ট পড়তে কখনো
মিস করিনি। এভাবে তার ভক্ত হয়ে যাই। তার মতো রিপোর্ট লেখা ও বিচিত্র বিষয়ে
রিপোর্ট সংগ্রহ করার আগ্রহ হয়।।
দৈনিক বাংলায় আমার সহকর্মী মুকুল ভাই
(বর্তমানে এনটিভির হেড অব নিউজ খায়রুল আনোয়ার) এক দিন বললেন, শওকত মাহমুদ
আমার রিপোর্টের খুব প্রশংসা করেছে। জানতে চেয়েছেন, ছেলেটি কে? বিজ্ঞান ও
পরিবেশ নিয়ে আমার রিপোর্ট ব্যতিক্রমধর্মী বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। মুকুল
ভাই তাকে আমার পরিচয় দিয়ে বলেছেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের
ছাত্র আমি। শওকত মাহমুদের প্রশংসার কথা শুনে আনন্দে মন ভরে যায়। মুকুল
ভাইকে অনুরোধ করি তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। শওকত মাহমুদ মুকুল ভাইয়ের
সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
এক দিন ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে একটি কর্মশালা
ছিল। এর ওপর রিপোর্ট করার জন্য দৈনিক বাংলা থেকে আমাকে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া
হয়। কর্মশালার প্রধান অতিথি ছিলেন হুমায়ুন ভাই। কয়েক দিন আগে সংবাদ
পত্রিকায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে শওকত মাহমুদের সাড়াজাগানো সিরিজ রিপোর্ট
প্রকাশিত হয়। অনুসন্ধানী এই রিপোর্টটির আদ্যোপান্ত পড়েছিলাম। সড়ক
দুর্ঘটনাবিষয়ক কর্মশালায় গিয়ে দেখি সেখানে শওকত মাহমুদও উপস্থিত। সংবাদ
থেকে তিনিও কর্মশালা কভার করতে এসেছেন। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করার কারণে
সেখানে তাকে বক্তব্য দেয়ারও সুযোগ দেয়া হয়। কর্মশালা শেষে তার কাছে গিয়ে
পরিচিত হলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব প্রশংসা করলেন। বললেন, মুকুল আপনার
কথা বলেছে। মনে হলো তিনি আমার অনেক দিনের চেনা। সেই থেকে তার সাথে হৃদ্যতা।
বড় ভাই হিসেবে দেখি, শ্রদ্ধা করি।
২০১১ সালের দিকে হার্টের চিকিৎসার
জন্য শওকত ভাই আমাকে ব্যাংককে নিয়ে যান। বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে এনজিওগ্রাম
করার পর প্রখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট ডা: আরাম সুচিত জানালেন, আমার হার্টে
পাঁচটি ব্লক। তিনি জরুরিভাবে বাইপাস বা স্ট্যান্টিং করার জন্য পরামর্শ দেন।
হার্টে পাঁচটি ব্লকের কথা শুনে ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু শওকত ভাই সাহস দিয়ে
বললেন, হার্টের চিকিৎসা এখন মামুলি ব্যাপার, ঝুঁকি নেই। তাই ভয় প্ওায়ার
কিছু নেই। বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে অপারেশন ব্যয়বহুল হওয়ায় তিনি আমাকে নিয়ে
গেলেন ব্যাংকক হাসপাতালের প্রখ্যাত হার্ট সার্জন অধ্যাপক ডা: কোসিনের কাছে।
তিনি সদ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই হাসপাতালে এসে যোগদান করেছেন। ডা: কোসিন
আমার এনজিওগ্রামের সিডি দেখে বললেন, বাইপাসের জন্য উপযুক্ত কেস। ব্যাংকক
হাসপাতালে ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য তৈরি হলাম, অপারেশনের তারিখ ঠিক হলো।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলল। এরই মধ্যে হাইপো-থাইরয়েড সমস্যা ধরা পড়ায় অপারেশনের
তারিখ পিছিয়ে যায়। এ অবস্থায় থার্ড ওপিনিয়নের জন্য আরেকজন চিকিৎসকের
শরণাপন্ন হই। বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের তরুণ কার্ডিওলজিস্ট ডা: সোয়াদচাই
পরীক্ষা করে আমাকে স্ট্যান্টিং বা রিং লাগানোর পরামর্শ দিলেন। ফলে বাইপাসের
চিন্তা বাদ দিয়ে ওই হাসপাতালেই ডা: আরামের কাছে স্ট্যন্টিংয়ের জন্য যাই।
আমার চিকিৎসার জন্য শওকত ভাই ১৫ দিন ব্যাংককে ছিলেন। এরপর সুস্থ হয়ে দেশে
ফিরি।
সাড়ে তিন বছর পর আবার হার্টে সমস্যা দেখা দেয়। এবার লেফট মেইন
আর্টারির অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গায় ব্লক ধরা পড়ে। ডাক্তার বলেছেন,
অতিরিক্ত স্ট্রেচের কারণে এ অবস্থা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য ব্যাংককে যাওয়ার
প্রস্তুতি নিই। কিন্তু শওকত ভাই দেশে নেই। ১৫ আগস্ট দুপুরে ফ্লাইট। আগের
রাতে হঠাৎ শওকত ভাইয়ের ফোন, ঢাকায় ফিরেছেন। বললেন, তিনি ব্যাংককে ছিলেন।
আমার যাওয়ার বিষয়টি জানা থাকলে তিনি সেখানে থেকে যেতেন। যা হোক, হাসপাতালে
ভর্তি হয়ে আমাকে সব কিছু জানাতে বললেন। এবার চিকিৎসার জন্য গেলাম ব্যাংককের
মহিদুল ইউনিভার্সিটির সিরিরাজ হাসপাতালে। সরকারি এ হাসপাতালের
ইন্টারন্যাশনাল ডিভিশন- সিরিরাজ প্রিয়মহারাজা কারুন হাসপাতালের কার্ডিয়াক
সেন্টারের বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক ডা: ধামরাজ আমাকে দেখলেন এবং ১৯
আগস্ট রাতে আমার এনজিওগ্রাফি ও ওসিটি এনজিওপ্লাস্টি করবেন বলে জানালেন।
ভর্তি হলাম সিরিরাজ হাসপাতালের হিজ ম্যাজিস্ট্রি কার্ডিয়াক সেন্টারে। শওকত
ভাইকে ১৮ আগস্ট একের পর এক ফোন করি। কিন্তু ফোনে তাকে পেলাম না। অবশেষে
শুনলাম একটি দুঃসংবাদÑ তাকে ঢাকার বসুন্ধরা শপিংমলের সামনে থেকে ওই দিনই
গ্রেফতার করা হয়েছে। খবরটি শুনে মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই
ঢাকায় চলে আসি। কিন্তু এসে কী করব, তাকে তো মুক্ত করা যাবে না। দেশে চলছে
জংলি শাসন। আইনকানুন বলতে কিছু নেই।
তবে শওকত ভাইয়ের শারীরিক অবস্থার
কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে পড়ি। তার হার্ট বাইপাস করা। আবার হার্টে তিনটি রিংও
লাগানো আছে। তিনি উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস রোগী। প্রায় দুই বছর আগে তার
ফুসফুসে পানি জমে এবং হার্ট ফেইলিওর হয়ে মরণাপন্ন অবস্থা হয়েছিল। এয়ার
অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া হয়। তার চিকিৎসার সময় সাথে
ছিলাম। প্রায় এক মাস চিকিৎসা শেষে দেশে আসেন। বর্তমানে তিনি হার্ট, কিডনি,
ডায়াবেটিস ছাড়াও পিত্তথলিতে পাথর, ব্যাকপেইন এবং চোখ ও দাঁতের সমস্যায়
ভুগছেন। তার সাথে সব সময় বলতে গেলে ওষুধের একটি ডিসপেনসারি থাকে। এমন
অসুস্থ একজন সাংবাদিককে গ্রেফতার করে জেলে নেয়া চরম নিষ্ঠুরতা ছাড়া কিছু
নয়।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে শওকত মাহমুদ একটি পরিচিত নাম। একজন
মেধাবী ও সৃজনশীল সাংবাদিক হিসেবে তার সুখ্যাতি রয়েছে। অগ্রজদের কাছে তিনি
যেমন প্রিয়, তেমনি অনুজদের কাছেও শ্রদ্ধেয়। লিখেন ভালো, বলেন ভালো। যুক্তি ও
তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কথা বলেন না। যেকোনো বিষয়ে তার বিশ্লেষণ উড়িয়ে দেয়া যায়
না। বর্তমানে তিনি সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ ফোরাম বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক
ইউনিয়ন-বিএফইউজের সভাপতি। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের দু’বার সভাপতি ও
চারবারের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয়
প্রেস ক্লাবের খ্যাতি ও আধুনিকায়নে তার বিশেষ অবদান রয়েছে। সাংবাদিক দম্পতি
সাগর-রুনি হত্যার প্রতিবাদসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা,
সাংবাদিকদের রুটি-রুজির আন্দোলন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের আন্দোলন
এবং মিডিয়া আক্রান্ত হওয়ার বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার থেকেছেন। টিভি
টকশোগুলোতে যুক্তির মাধ্যমে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। সাংবাদিকদের যেকোনো
বিপদ-আপদেও তিনি ঝাঁপিয়ে পড়ে সহযোগিতা করেছেন। সত্যিকার অর্থেই তিনি দেশের
সম্পদ। কিন্তু তাকে অমানবিকভাবে গ্রেফতার করা হয়। তার কণ্ঠ স্তব্ধ করা জন্য
ইতঃপূর্বে উদ্দেশ্যমূলক মামলায় জড়ানো হয়। পেট্রল বোমা হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও
বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ধারায় এ মামলাগুলো দেয়া হয়। একজন পেশাজীবী সাংবাদিক
এবং সাংবাদিক নেতার বিরুদ্ধে এই ধরনের উদ্দেশ্যমূলক মামলা নজিরবিহীন। টিভি
টকশো, লেখালেখি এবং পেশাজীবীদের বিভিন্ন সভা সমাবেশ, গোলটেবিল বৈঠক ও
মানববন্ধনে তিনি অংশ নিয়েছেন, বক্তব্য দিয়েছেন। এর বাইরে তার কোনো তৎপরতা
ছিল না। রাজপথে তিনি গাড়িতে বোমা হামলা কিংবা ভাঙচুর করেছেন এটা কি
বিশ্বাসযোগ্য? পাগলেও এ কথা বিশ্বাস করবে না। শওকত মাহমুদ কি এ কাজ করতে
পারেন? কখনোই নয়।
শওকত মাহমুদকে কেন গ্রেফতার করা হলো? তার অপরাধ কী?
অন্যায়ের প্রতিবাদ করা একজন নাগরিকের নৈতিক অধিকার। তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ
করেছেন। এটাই কি তার অপরাধ? তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। বিএনপি
চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। এটাই কি তার অপরাধ? একজন নাগরিক
হিসেবে তার কি রাজনীতি করার অধিকার নেই? এ জন্য কি গ্রেফতার করতে হবে?
রিমান্ডে নিতে হবে? নির্যাতন করতে হবে?
জাতীয় প্রেস ক্লাব ৬০ বছরের একটি
ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক,
স্বৈরাচারবিরোধী ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এ ক্লাবের ভূমিকা রয়েছে। জাতীয়
প্রেস ক্লাবকে অভিহিত করা হতো-‘গণতন্ত্রের একখণ্ড দ্বীপ’ হিসেবে। ক্লাবটি
সব সময়ই গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু এবার সেই ঐতিহ্যকে
ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। ক্লাবের নির্বাচন বানচাল করে দিয়ে আওয়ামী দখলীকরণ করা
হয়েছে। নির্বাচন ছাড়া, সদস্যদের ভোট ছাড়া একটি ঘোষিত দখলদার কমিটি রাতের
অন্ধকারে তালা ভেঙে ক্লাব দখল করে নিয়েছে। সেই দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
করেছিলেন শওকত মাহমুদ। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন করতে হবে এবং নির্বাচনের
মাধ্যমে সদস্যরা যাকে খুশি তাকে ক্লাবের দায়িত্বে নির্বাচিত করতে পারেন।
সেই নির্বাচিত কমিটিই ক্লাব পরিচালনা করবে। এটাই তার অপরাধ।
শওকত
মাহমুদকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ ও মুক্তির দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন সাবেক
প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, জাতীয় প্রেস ক্লাব
দলীয়করণের প্রতিবাদ করায় সরকার তাকে গ্রেফতার করেছে। তার এই বক্তব্য
যথার্থ। কিন্তু এ বক্তব্যে প্রেস ক্লাব দখলদারদের গাত্রদাহ হয়েছে। দখলদার
কমিটির সাধারণ সম্পাদক খালেদা জিয়ার বিবৃতির প্রতিবাদ করার স্পর্ধা পর্যন্ত
দেখিয়েছেন। অথচ তাকে সাংবাদিক মোজাম্মেল হক ও শওকত মাহমুদের সুপারিশে
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ১৯৯২-৯৩ সালে সরকারি বার্তা সংস্থা
বাসস-এ চাকরি দেন। বাসস থেকে প্রধানমন্ত্রীর রিপোর্ট করার জন্য তাকে
সংযুক্তও করা হয়। অসংখ্য দেশে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী করা হয়। খালেদা
জিয়ার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে তার হাত এতটুকু কাঁপেনি। ওয়ান-ইলেভেনের সময়
খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে ১৫ জন বিশিষ্ট সম্পাদকসহ ৭০০ সাংবাদিক বিবৃতি
দিয়েছিলেন। সেই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতেও তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
হঠাৎ
শওকত মাহমুদকে কেন গ্রেফতার? অনেকেরই ধারণা তার গ্রেফতারের পেছনে
স্বার্থান্বেষী কিছু সাংবাদিক নেতারও ইন্ধন থাকতে পারে। তার মেধা এবং
নেতৃত্বের গুণাবলি তাদের ঈর্ষার কারণ। তাই এই সুযোগ তারা কাজে লাগিয়েছে।
তার ওপর যে নিষ্ঠুর জুলুম হচ্ছে তা এক কথায় অবর্ণনীয়। এক মাসেরও বেশি সময়
ধরে তিনি বন্দী। গ্রেফতারের আগে তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা ছিল। এখন তাকে আরো
মামলায় জড়ানো হয়েছে। মামলার সংখ্যা এখন ২১টি। আরো ১১টি মামলায় জড়ানোর
ষড়যন্ত্র চলছে। একের পর এক মামলায় তাকে রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। আদালতের কাছে
পুলিশ ১২টি মামলায় তার ১২০ দিনের রিমান্ড চায়। আদালত বিভিন্ন মামলায় তাকে
১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। মতিঝিল থানা, পল্টন থানা ও ডিবি অফিসে ১৪ দিন
তাকে রিমান্ডে নিয়ে রাখা হয়েছে। রিমান্ডের চেয়েও কোর্টে হাজিরার জন্য
আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে তাকে হয়রানি-নির্যাতন বেশি করা হচ্ছে। গাজীপুরের
কাশিমপুর কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে আনা-নেয়া করা হয়। এই গরম এবং
তীব্র যানজটের মধ্যে প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা তাকে প্রিজন ভ্যানে আলো-বাতাসহীন
দমবন্ধ অবস্থায় কাটাতে হচ্ছে। একজন গুরুতর হার্টের রোগী হলেও তাকে আদালতের
আটতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠানো-নামানো হচ্ছে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অসুস্থ শরীরে
এই নিষ্ঠুর নির্যাতন এখন তার প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। একজন মেধাবী সাংবাদিক
বিনা কারণেই এই নির্যাতন ভোগ করছেন। জামিন চাইলেও তাকে জামিন দেয়া হচ্ছে
না। ইতোমধ্যে তার ১০ কেজি ওজন কমে গেছে। বুকের সাথে পিঠ লেগে গেছে। চেহারা
ভেঙে গেছে। তার সাথে কী নির্দয় আচরণ করা হচ্ছে কোর্টে হাজিরা দিতে আসা তার
ছবিই প্রমাণ।
পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা
নিতে আদালতের আদেশও আমলে নিচ্ছে না কারা কর্তৃপক্ষ। কারাবিধি মোতাবেক
সম্মানিত নাগরিক হিসেবে ডিভিশন পাওয়ার সুযোগ থাকলেও তাকে ডিভিশন না দিয়ে
সাধারণ হাজতি হিসেবে রাখা হচ্ছে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী বাসার খাবার
তাকে দিতে দেয়া হচ্ছে না। দিন দিন তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। তার
জীবন ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
শওকত মাহমুদের মতো একজন মেধাবী
সাংবাদিকের ওপর এই নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা বন্ধ হোক। এই কলমসৈনিককে অবলিম্বে
মুক্তি দিয়ে সাংবাদিকদের মাঝে ফিরিয়ে দেয়া হোক। হ
লেখক :সৈয়দ আবদাল আহমদ। সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক
Comments[ 0 ]
Post a Comment