‘জীবনে
বহু ঘূর্ণিঝড় দেখেছি। হারিয়েছি অনেক স্বজন, কিন্তু মনোবল হারাইনি। রোয়ানুর
আঘাতে কিরণপাড়ার শতাধিক ঘর ভেঙে গেছে, কিন্তু আমরা ভেঙে পড়িনি। সাহসকে
সম্বল করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি।’
বলছিলেন কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার আলীআকবরডেইল ইউনিয়নের কিরণপাড়ার জেলে শাহ আলম (৬৩)।
গত বৃহস্পতিবার সমুদ্রতীরবর্তী আলীআকবরডেইল ইউনিয়নের কিরণপাড়া, সাগরপাড়া ও গহরপাড়া ঘুরে এ রকম আরও সাহসী মানুষের সঙ্গে কথা হয়।
শাহ
আলমের পাশের ঘরের কাঞ্চন মিয়া (৫২) বলেন, ‘২৫ বছর আগের প্রলয়ংকরী
ঘূর্ণিঝড়ে এই দ্বীপের ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সে সময় নারিকেলগাছ
ধরে টানা চার ঘণ্টা ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রাণ রক্ষা করেছি। অথচ এখন
আমরা ভাঙা বেড়িবাঁধের সংস্কারের জন্য সরকারের দিকে চেয়ে আছি।’
কিরণপাড়ার
পশ্চিমে পাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি লম্বা বেড়িবাঁধ। পানি থেকে ১০ ফুট দূরত্বে
বেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়িঘরে বসবাস করছে কয়েকটি পরিবার।
একটি ঘরের বাসিন্দা
গৃহবধূ সালমা খাতুন (৪৪) বলেন, ‘রাতে যখন ঘুমাতে যাচ্ছিলাম, তখন সমুদ্র তিন
হাত দূরে। জানা ছিল, এর বেশি পানি উঠবে না। কিন্তু নিম্নচাপের কারণে এখন
সমুদ্র প্রচণ্ড উত্তাল। তাই একটু সতর্ক থাকতে হবে।’
কিরণপাড়ার উত্তরে বেড়িবাঁধের কিছু অংশ ভাঙা। এই ভাঙা অংশ দিয়ে সাগরের পানি ঢুকে কয়েকটি গ্রামের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে।
একই
পরিস্থিতি দেখা গেল উত্তর ধুরুং ইউনিয়নেও। রোয়ানুর প্রভাবে সৃষ্ট
জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে ইউনিয়নে সাত হাজারের মতো ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে।
কিন্তু মনোবল হারাননি এলাকার বাসিন্দারা।
ইউনিয়নের আকবরবলীপাড়ার গৃহবধূ
রশিদা বেগম (৪৫) ভাঙা বেড়িবাঁধ দেখিয়ে বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিরা বললে গ্রামের
হাজারো মানুষ বেড়িবাঁধ সংস্কারে নেমে যাবে। তাহলে অন্তত ঘরবাড়িতে জোয়ারের
পানি ঢুকে যাওয়া ঠেকানো যাবে। কিন্তু সাহসী মানুষগুলোকে মাঠে নামানোর কেউ
নেই। সাহস আছে বলেই আমরা জন্মভিটায় পড়ে আছি।’
উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন
পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহরিয়ার চৌধুরী বলেন, ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত
লোকজনের মধ্যে সরকারি-বেসরকারিভাবে এ পর্যন্ত প্রায় এক কোটি টাকার
খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু এই টাকায় ভাঙা বেড়িবাঁধের কিছু অংশ
সংস্কার করলে মানুষ বেশি লাভবান হতো। তিনি বলেন, বেড়িবাঁধ নেই বলেই
শ্রমজীবী মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারছে না।
শাহরিয়ার চৌধুরী
বলেন, এখানকার মানুষ সাহসী। কিন্তু আর্থিক সংকটে অনেকে বিপর্যস্ত। আগে
স্বেচ্ছাশ্রমে ভাঙা বেড়িবাঁধের সংস্কার হলেও এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ
লোকজন টাকা ছাড়া কাজ করতে রাজি হচ্ছে না। তা ছাড়া স্বেচ্ছাশ্রমে প্রায় ১০
কিলোমিটারের ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কার মোটেও সম্ভব নয়।
এই ইউনিয়নের আজম
সড়কের দুপাশে ঝুপড়িঘর তৈরি করে বসবাস করছে গৃহহীন শতাধিক পরিবার। অধিকাংশ
ঘরে কোনো পুরুষের দেখা মেলেনি। তাঁরা আয়-রোজগারের জন্য কক্সবাজার ও
চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় পাড়ি জমিয়েছেন।
একটি ঘরের বাসিন্দা আলেয়া
বেগম (৩৫) বলেন, ‘সমুদ্র উপকূলেই আমাদের জন্ম। সমুদ্রের গর্জন আমাদের সাহসী
করে তোলে। কিন্তু নানা অবহেলায় আমরা দুর্বল হয়ে পড়ছি। গত ২৫ বছরে টেকসই
বেড়িবাঁধ নির্মাণের নামে শত কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু স্থায়ী
বেড়িবাঁধ হচ্ছে না।’
Comments[ 0 ]
Post a Comment