টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে
বাসাবাড়ি-দোকান-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান- কারখানা৷ প্রায় যানবাহনহীন জলাবদ্ধ
সড়ক৷ টানা তৃতীয় দিনের বৃষ্টিতে গতকাল রোববার এই স্থবির চেহারা ছিল
চট্টগ্রাম মহানগরের৷ ব্যবসা-বাণিজ্যেও নেমেছে স্থবিরতা৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
বন্ধ৷
সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা৷
সড়ক যোগাযোগব্যবস্থাও ছিল প্রায় অচল৷ চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য
ওঠানো-নামানোর কার্যক্রমও ব্যাহত হয়েছে৷
>>টানা
বৃষ্টিতে দুর্ভোগের শেষ নেই৷ অনেকে প্রধান সড়কের ওপর জমে থাকা বুকসমান
পানির ওপর দিয়ে হেঁটে গন্তব্যে যান৷ ছবিটি নগরের ২ নম্বর গেট এলাকা থেকে
তোলা l সৌরভ দাশ
সঞ্চরণশীল
মেঘমালা ও লঘুচাপের কারণে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি
গতকালও অব্যাহত ছিল৷ পতেঙ্গা আবহাওয়া দপ্তর সূত্র জানায়, গতকাল সকাল ছয়টা
থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত ১৩৮ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা
হয়েছে৷ এই বৃষ্টিতে নগরজুড়ে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা৷ কোনো কোনো সড়কে
কোমরসমান, আবার কোথাও এর চেয়ে বেশি পানি জমে৷ সড়কগুলোতে রিকশা,
রিকশাভ্যান ছাড়া যান্ত্রিক যানবাহন তেমন দেখা যায়নি৷ লোক চলাচলও ছিল কম৷
রেল
যোগাযোগ বন্ধ: সকাল থেকে প্রবল পাহাড়ি ঢলে শহর থেকে সাড়ে ১৬
কিলোমিটার দূরে ভাটিয়ারী ও কুমিরার মধ্যবর্তী স্থানে রেলওয়ের নির্মাণাধীন
৩৪ নম্বর সেতুর তলদেশের অস্থায়ী সুরক্ষা নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় সেতুটি
ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। রেললাইনের কর্মীরা বেলা ১১টা ২০ মিনিটের দিকে এই খবর
সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানান৷ এরপর ওই সেতুতে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় সারা দেশের
সঙ্গে চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ প্রকৌশল ও ঠিকাদাির
প্রতিষ্ঠানের শতাধিক কর্মী সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা কাজ করে সেতুটি মেরামত করলে ওই
লাইন দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল শুরু হয়৷ প্রবল
স্রোতের কারণে আপ-লাইনের সেতুর মেরামতকাজ সন্ধ্যা পর্যন্ত শুরু করা যায়নি।
দুই বছর আগেও সেতুটি পাহাড়ি ঢলে ধসে পড়েছিল।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা
জানান, ৩৪ নম্বর সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সিলেট থেকে ছেড়ে আসা উদয়ন
এক্সপ্রেস ও চাঁদপুর থেকে ছেড়ে আসা মেঘনা এক্সপ্রেস কুমিরা স্টেশনে আটকা
পড়ে। ঢাকাগামী কর্ণফুলী ফৌজদারহাট স্টেশনে আটকা পড়ে। মহানগর গোধূলী এক
ঘণ্টা ৫০ মিনিট দেরিতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার দিকে যাত্রা করে। ঢাকা থেকে
ছেড়ে আসা প্রভাতী ও জালালাবাদও দেড় থেকে দুই ঘণ্টা দেরিতে চট্টগ্রামে
পৌঁছায়।
অাটকে পড়া ট্রেনগুলোর যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়৷
চট্টগ্রাম–গামী দুটি ট্রেনের যাত্রীরা কুমিরা স্টেশনে নেমে সড়কপথে
চট্টগ্রাম নগরে যান৷
কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের যাত্রী মনির আহম্মদ বলেন,
‘১১টায় আমরা ফৌজদারহাটে আটকা পড়ি। দ্রুত সময়ে সেতু মেরামতের কথা বলে
আমাদের আশ্বস্ত করা হয়। অথচ দীর্ঘক্ষণ ট্রেনে আটকে থাকায় চরম দুর্ভোগ
পোহাচ্ছি।’
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোজাম্মেল হক প্রথম
আলোকে বলেন, স্রোতের তীব্রতার কারণে ৩৪ নম্বর সেতুর অস্থায়ী সাপোর্ট
নড়বড়ে হয়। ঠিকাদাির প্রতিষ্ঠান ও রেলের প্রকৌশলী ও কর্মীরা দীর্ঘ সময়
চেষ্টা চালিয়ে সেতুটি রেল চলাচলের উপযোগী করেন৷ বিকেলের দিকে রেল
যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়ে আসে।
সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত: বৃষ্টির কারণে
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট এলাকায় রাস্তা ভেঙে যাওয়ায়
তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাস
গতকাল বিকেল পর্যন্ত চট্টগ্রামে পৌঁছেনি বলে জানা গেছে। এই যানজট ও
মহাসড়কে খানাখন্দের কারণে যান চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে।
সকালে মুষলধারে বৃষ্টির সময় ষোলশহরসহ বিভিন্ন সড়কে পানি জমে যাওয়ায় কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ সাময়িক বন্ধ ছিল।
উড়োজাহাজে
যাত্রী কম: দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও জলাবদ্ধতার কারণে গতকাল ঢাকাগামী
উড়োজাহাজের ৮ থেকে ১০ শতাংশ যাত্রী চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পৌঁছাতে
পারেনি। যাত্রী কম নিয়ে চারটি সংস্থার উড়োজাহাজ চট্টগ্রাম বিমানবন্দর
থেকে ছাড়ে৷
বিমানবন্দরের অভিবাসন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ
মিজানুর রহমান বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ৮ থেকে ১০ শতাংশ যাত্রী
কম পরিবহন হয়েছে বলে চারটি বিমান সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
জলাবদ্ধতা:
সকালের প্রবল বৃষ্টিতে প্রায় গলাসমান পানি জমে নগরের ষোলশহর, মুরাদপুর,
বহদ্দারহাট, কাপাসগোলা, বাকলিয়ায়। এসব সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে৷
আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের কার্যালয়ে পানি ঢুকে পড়ে। বাদুড়তলা,
মোহাম্মদপুর, ডিসি রোড, কাপাসগোলায় বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ে। যানবাহন
চলাচল কমে গেছে। মাঝেমধ্যে দু-একটি রিকশা চললেও ভাড়া তিন গুণ বেড়ে গেছে।
ব্যবসায়
স্থবিরতা: বেপজা সূত্র জানায়, বৃষ্টিতে ইপিজেডের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের
নিচতলায় পানি ঢুকে গেছে৷ এতে পণ্য ওঠা-নামা ব্যাহত হয়। নগরের প্রধান
বাণিজ্যিক এলাকা খাতুনগঞ্জ ও আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় সকালে পানি ওঠায় এ
দুই এলাকায় স্থবিরতা নেমে আসে। চাক্তাইয়ের আড়তদার মো. জাকারিয়া বলেন,
‘বৃষ্টিতে তিন-চার দিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। বৃষ্টির কারণে
গাড়িতে পণ্য ওঠানো-নামানো যাচ্ছে না।’
বৃষ্টিতে পোলট্রি খামারিরাও
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নগর এবং বিভিন্ন উপজেলার বেশ কিছু মুরগির খামারে পানি
ঢুকে গেছে। এতে অনেক মুরগির বাচ্চা মারা গেছে। ফতেয়াবাদের শফিউল আজম বলেন,
‘বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে আমার খামারে পানি ঢুকে কয়েক শ মুরগি মারা যায়। আমার
মতো আরও অনেকের একই অবস্থা হয়েছে।’
পতেঙ্গা আবহাওয়া দপ্তর জানায়, উত্তর
বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি বায়ু প্রবল থাকায় আগামী ২৪ ঘণ্টায় সঞ্চরণশীল মেঘমালা
সৃষ্টি হবে। এ সময় চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা
রয়েছে। একই কারণে দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত
দেখাতে বলা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত মাছ ধরার নৌকা ও
ট্রলারগুলোকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
Comments[ 0 ]
Post a Comment